"বন্দেমাতরম" প্রকাশের ১৫০ তম বর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি : ---- বিমল দাস




“বন্দেমাতরম”— এক সঙ্গীত, এক মন্ত্র, এক জাতির আত্মার অনন্ত ধ্বনি।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত এই গান শুধু কবিতার নয়, এটি ভারত আত্মার ভাষা, যেখানে মাতৃভূমি কেবল ভূমি নন, তিনি দেবী, তিনি শক্তি, তিনি চেতনা।


বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭৫ সালে এই গান রচনা করেন, এবং ১৮৮২ সালে উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে ভিত্তি করে রচিত তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস “আনন্দমঠ”-এ তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন ‘বন্দেমাতরম’— এক চিরজাগ্রত দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্র।


বঙ্কিমের এই গান শুধু সাহিত্য নয়, এটি ভারতের আধ্যাত্মিক শরীরের প্রতীক।

ভারতবাসীর পঞ্চময় কোষের সঙ্গে বন্দেমাতরম গভীরভাবে সম্পর্কিত —


১) অন্নময় কোষ — প্রথম দুটি পংক্তিতে মাতৃভূমির সুজলা সুফলা ভূমির বন্দনা,

যেখানে মা তাঁর সন্তানদের আহার ও বেঁচে থাকার শক্তি দেন।


২) আনন্দময় কোষ — তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ লাইনে মাতৃভূমির শ্যামল সৌন্দর্যে মগ্ন আত্মার আনন্দের প্রকাশ।


৩) প্রাণময় কোষ — সপ্তম থেকে একাদশ লাইন পর্যন্ত মাতৃভূমি যেন প্রাণসঞ্চারিণী দেবী, যিনি জাতিকে জাগিয়ে তোলেন।


৪) মনোময় কোষ — দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ লাইন পর্যন্ত মায়ের শুভ আশীর্বাদে মন জাগে, সৃষ্ট হয় দেশপ্রেমের অনুভূতি।


৫)বিজ্ঞানময় কোষ — শেষ অংশে মাতৃভূমি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস, যিনি সন্তানের মনে জাগান জ্ঞানের আলো।


এই কারণেই ‘বন্দেমাতরম’ ভারতবাসীর অন্তরে আগুন জ্বালাতে পেরেছিল।


১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল মৃত্যুশয্যায় বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর মেয়েকে বলেছিলেন—“দেখবি, এই গান একদিন ভারতবাসীর রক্তে আগুন ধরিয়ে দেবে।”

ঋষির সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রভাতে ,যেখানে তরুণ বিপ্লবীর শেষ উচ্চারণ ছিল “বন্দেমাতরম!”


বন্দেমাতরমে প্রথম সুরারোপ করেন যদু ভট্ট।

এরপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৬ সালে কলকাতার বিডন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম রাজনৈতিক মঞ্চে এই গানটি পরিবেশন করেন।

১৯০১ সালে কংগ্রেসের কোলকাতা অধিবেশনে দক্ষিণাচরণ সেন,

এবং ১৯০৫ সালে বারাণসী অধিবেশনে সরলাদেবী চৌধুরানী “বন্দেমাতরম” পরিবেশন করেন। পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর সুরে ও লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে এই গান চিরকালীন রূপ লাভ করে।

আধুনিক যুগে এ. আর. রহমান ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে  সুরারোপ করেন, তাঁর “Maa Tujhe Salaam” অ্যালবামে।

আজ পর্যন্ত ১০৭টি ভিন্ন সুরে বন্দেমাতরম পরিবেশিত হয়েছে —

প্রথম সুরকার যদু ভট্ট, সর্বশেষ এ. আর. রহমান।


২০০২ সালে BBC World Service-এর নির্বাচনে, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০টি গানের মধ্যে

এ. আর. রহমানের “বন্দেমাতরম” দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে — যা ভারতীয় সংগীতের গৌরবময় ইতিহাসে এক অমর মুহূর্ত।


১৯০৯ সালে শ্রী অরবিন্দ ঘোষ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন — “Mother, I Bow to Thee!”

তিনি এই গানকে অভিহিত করেন “National Anthem of Bengal” নামে।

১৯০৭ সালে হিরালাল সেন পরিচালিত ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে

শেষ দৃশ্যের গান ছিল — ‘বন্দেমাতরম’।


কিন্তু পরে কিছু মুসলিম সংগঠন দাবি করে —

দেশকে দেবীরূপে বন্দনা করা তাদের ধর্মবিরোধী;

ফলে তদানীন্তন রাজনৈতিক নেতারা মুসলিম তোষণের চাপে গানের প্রথমাংশটিকেই সরকারি অনুমোদন দেন,

অর্থাৎ “বন্দেমাতরম সুজলাং সুফলাং...” পর্যন্ত অংশটিই সরকারি মর্যাদা পায়।


এই গান ছিল ভারতের জাতীয় ধ্বনি, বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা।

ব্রিটিশ সরকার জনসমক্ষে “বন্দেমাতরম” উচ্চারণ নিষিদ্ধ করেছিল— কারণ তারা জানত,

এই একটি শব্দই একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে!


মাতঙ্গিনী হাজরা শহীদ হওয়ার আগে শেষ যে শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন, তা ছিল “বন্দেমাতরম”।

ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার (ডাক্তারজি) তাঁর ছাত্রাবস্থায় বিদ্যালয়ে

“বন্দেমাতরম” ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।


১৯০৭ সালে ভিখাজী কামা যখন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা নির্মাণ করেন,

তার মাঝখানে দেবনাগরী হরফে লেখা ছিল — “বন্দেমাতরম”।

পরে ১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জনগণমন” জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেলে,

“বন্দেমাতরম”-কে ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে সম্মানিত করা হয়।


“বন্দেমাতরম” শুধু একটি গান নয়,

এটি ভারতের আত্মার অন্ন থেকে আনন্দ, প্রাণ থেকে চেতনা —

সমগ্র জাতির পঞ্চকোষে স্পন্দিত এক মহামন্ত্র।

বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে জন্ম নেওয়া এই সঙ্গীত

আজও কোটি ভারতবাসীর অন্তরে শক্তি, ভক্তি ও মুক্তির জাগরণ আনে।

 “বন্দেমাতরম” – এই এক শব্দেই লুকিয়ে আছে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, ভক্তি, ও বিপ্লবের প্রতিটি ছন্দ।

বঙ্কিমের সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজও সত্য—

“এই গানই ভারতবাসীর রক্তে আগুন ধরিয়ে দেবে।”


আজ সাহিত্য সম্রাটের অমর সৃষ্টি ‘বন্দেমাতরম’-এর ১৫০ তম রচনা দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।


 

Comments

Popular posts from this blog

মুর্শিদাবাদ কি মুঘলস্থানের পথে? ওয়াকফের নামে কীভবে হিন্দু নির্যাতন হয়েছে? ---- ডক্টর সুমন চন্দ্র দাস

রাজা তোর কাপড় কোথায়? --- সুমন চন্দ্র দাস