এক অনন্ত সূর্য : সুমন চন্দ্র দাস
সূর্য সেন, জন্ম ২২ মার্চ ১৮৯৪ এবং মৃত্যু ১২ই জানুয়ারি ১৯৩৪।
জন্ম নোয়াপাড়া, রাউজান উপজেলা, চট্টগ্রাম। বাবা রাজমনি সেন, মা শশিবালা সেন। তাঁদের দুই ছেলে এবং চার মেয়ে ছিলেন। বড় ছেলে সূর্য সেন। বাল্যকালে বাবকে হারিয়ে কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হন। ছোট্ট বেলা থেকেই মেধাবী এবং ধর্ম মনোভাব স্বভাবের ছেলে ছিলেন সূর্য সেন। প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নোয়া পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম নন্দন কাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফ এ তে ভর্তি হন। পরে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ পড়াশুনা করেন। চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অসহযোগ আন্দলনের পর স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ান বাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধরি প্রতিষ্ঠিত উমাতারা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর পরাক্রমের অধিকারী ছিলেন মাস্টরা দা। ডাক নাম ছিল কালু দা। তিনি মূলত উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই বঙ্গের বিপ্লবীদের সঙ্গে ভীষণ সম্পর্ক হয়ে ওঠে এবং সূর্য সেন মাষ্টার দা হিসাবে সকলের কাছে পরিচয় লাভ করেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে অনুশীলন সমিতির সভাপতি ছিলেন প্রমথনাথ মিত্র এবং কোষাদক্ষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ মিত্র। এই সমিতিতে যুক্ত হন অরবিন্দের অনুজ বারিন্দ্র কুমার ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনুশীলন সমিতির লাঠি খেলা, অসি খেলা, ছোরা খেলা চলত। ইতি মধ্যেই বারীন্দ্র কুমার যুগান্তর বলে আলাদা দল তৈরি করেন। পুলিন দাস ছিলেন ঢাকার অনুশীলন সমিতির সভাপতি। এই সময়ে ঢাকার প্রতুল গাঙ্গুলী, কেদারেশ্বর সেন, রবি সেন প্রমুখ। কলকাতার মাণিকতলায় বোমার কারখান নির্মাণ করেন বারীন্দ্র ঘোষ। পরে অরবিন্দ ঘোষ সহ অনেকেই আলিপুর বোমা মালায় অভিযুক্ত হন। এই অনুশীলন সমিতিকে আরবিন্দ ঘোষ এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস আর্থিক সাহয্য করতেন। তাঁর একক নেতৃত্বে শত শত বঙ্গের বিপ্লবী স্বদেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সংগঠিত হয়। গোপন ভাবে সশস্ত্র বিপ্লবীদের পরিচালনা করতেন। ৮ই এপ্রিল ১৯৩০ সাল শুক্রবার রাত্রি আটটায় ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা হয়। রাতেই ধুম ষ্টেশন থেকে একটা মালবাহী ট্রেন লাইন চ্যুত হয়ে যায়। আরেকটা দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিসে আক্রমণ করে। হাতুরি দিয়ে সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয়। পেট্রল ঢেলে সব কিছু আগুন লাগিয়ে দেয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়েতে অস্ত্রাগারে দখল নেয়। উন্নত মানের আধুনিক অস্ত্র উদ্ধার হয় তবে কোন গুলি উদ্ধার হয় নি। দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। সমস্ত পুলিশ লাইন জুড়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ দেওয়া হয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। এই সংঘর্ষে ব্রিটিশ বাহিনী পাড়ায় ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর প্রায় ১২ জন হুতামা হন। মাষ্টার দা কে ইংরেজ সরকার জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরার পরিকল্পনা করেন। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভার বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারিতে এক বৈঠকে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন দত্ত, সুশীল দাশগুপ্ত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ব্রজনের সহদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতিকে পুলিশের কাছে খবর দিয়ে দেন।পুলিশ রাত্রি ১০ টায় গোটা বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। অন্ধকারে গুলি বিনিময় হয়। কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত পালিয়ে যেতে পারেন কিন্তু অস্ত্র সহ সূর্য সেন এবং ব্রজ সেন ধরা পরেন। ১৭ ই ফেব্রুয়ারী রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজসেন প্রথমে জেলা গোয়েন্দা দফতরে তারপর কোর্টে নিয়ে গিয়ে চট্টগ্রাম জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুড়ি দিয়ে দাঁত ভেঙ্গে দেয় মাষ্টার দার। তাঁদের হাড়ে ব্যাপক আঘাত করা হয় অজ্ঞান হয়ে গেলে অর্ধমৃত অবস্থায় ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দেয়। মৃত্যুর পরে দুই জনের দেহ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে দেওয়া হয় নি। বুকে লোহার টুকরো বেঁধে ট্রাকে করে নিয়ে ব্রিটিশ ক্রুজার ‘The Reneown’ বঙ্গপোসাগরে ফেলে দেওয়া দেয় । এই বিপ্লবীকে পরে ব্রিটিশ পুলিশ মৃত্যুরপরও কোন মানবিক আচরণ করেতে দেখা যায় নি। মাষ্টার দার নির্মম মৃত্যু এক ঐতিহাসিক কালা অধ্যায়। উল্লেখ্য বঙ্গ মাতার এই বীর সন্তানের পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম আজ ভারতের মধ্যে নেই। স্বাধীনতার বিপ্লবী সংগ্রামের এই পুণ্যভূমি স্মৃতি বিজড়িত ভূখণ্ড দেশভাগ চক্রান্ত এবং যন্ত্রনার স্মৃতির ৭৫ তম বর্ষ। বাঙ্গালী সমাজের মনে সেই স্মৃতি আজও অম্লান।

Comments
Post a Comment