২০২১ বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী যন্ত্রনার দুই বছর: কিছু শিক্ষা, কিছু শপথ। ---- কবি কালিদাস


২০২১ সালের ২রা মে, বঙ্গবাসীর জীবনে অনিশ্চয়তার এক অন্ধকার এনে উপস্থিত করেছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন প্রকৃত অর্থে এক সর্বজনীন উৎসব। কিন্তু সেই উৎসবের দিনেই অনাচার আর দুরাচারের তমসা এসে উৎসবের আলোকে ম্লান করে দিয়েছিল। এক শ্রেণীর বিজয়োল্লাস অপরকে ভয়াবহদুর্বিপাকে ঠেলে দিয়েছিল। রক্ত হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল কিছু বর্বর। সঙ্গে হত্যা, লুন্ঠন, নারী নির্যাতন, নৈরাজ্য এবং সর্বপ্রকার অপরাধের দানবোল্লাস প্রত্যক্ষ করেছিল বঙ্গবাসী। নির্বাচন পরবর্তী এমন হিংসার নমুনা এ পশ্চিমবঙ্গ তথা এই ভারতবাসী আগে হয়তো কোনোদিন চাক্ষুষ করেনি। ৩০৩ জন বিজেপি কর্মী নির্বাচনের পরবর্তী হিংসায় ঘরছাড়া হয়( তথ্য সূত্র: 12 April, 2022, indiatoday.in)। সাধারণ মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বাইরে  ওড়িশা,  ঝাড়খণ্ডের মতন জায়গায়। ফল ঘোষণার সেই রাতেই ঝরেছিল অন্তত বারোটি প্রাণ (তথ্য সূত্র: 4 May, 2021, bangla.aajtak.in)। আর কত নারীর সম্মান লুন্ঠন হয়েছিল, তার হিসাব নেই। মানুষ প্রাণে বাঁচার আশায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক এক লক্ষ শাসক বিরোধী মানুষ গৃহহারা হয়েছিল (তথ্যসূত্র: 6 May, 2021, hindustantimes.com)। বাড়ি, ঘর, দোকান, বাজারে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। নির্বাচনোত্তর সহিংসতা নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়। মামলার শুনানি হয় কলকাতা হাইকোর্টের পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চে। হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দলের নেতৃত্বে গড়া এই ডিভিশন বেঞ্চের অন্য চারজন বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি ইন্দ্র প্রসন্ন, বিচারপতি সৌমেন সেন, বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি সুব্রত তালুকদার।  কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তৈরি করা কমিটির কাছে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ৩ হাজার ২৪৩টি অভিযোগ জমা পড়ে। প্রাণের ভয়ে প্রায় চারশোজন সাধারণ নাগরিক আসামে গিয়ে আশ্রয় নেয় (তথ্যসূত্র: 4 May, 2021 bengali.abplive.com)। অগণিত নারী নির্যাতনের ঘটনাও সামনে আসতে থাকে( তথ্যসূত্র: June 28, 2021 m.thewire.in)। স্বাভাবিক ভাবে বলাই যায় রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারা বের হয়েছিল। আজ সেই ঘটনার দুই বছর পরও শিউরে যেন উঠতে হয়! পশ্চিমবঙ্গ আজ শান্তি-শৃঙ্খলা  কেবল কথার কথা হয়েই রয়ে গিয়েছে। দিকে দিকে বিভিন্ন অশান্তির ঘটনা বাংলার শাসন ব্যবস্থার দৈন্য দশাকেই সূচিত করছে। রাজ্যে শিল্প, কারখানা বিদায় নিয়েছে। রাজনীতিই মানুষের কাছে জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায় হিসাবে অবশিষ্ট রয়েছে। শিক্ষিত বেকারেরা পথ দখল করে বসে আছে চাকরির আশায়। লগ্নিকারীরা মুখ ফিরিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। মাৎস্যন্যায়ের যুগ যেন আবার ফিরে এসেছে পশ্চিমবঙ্গে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আজ রাজনৈতিক ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা না থাকলে সাফল্য মেলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন শব্দটিই যেন সাধারণ মানুষের জীবনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। কারণ নির্বাচন মানেই হত্যালীলা, সন্ত্রাস, নারীনির্যাতনের বিভীষিকা। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন সময়কালীন সন্ত্রাস যে মানুষগুলির প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, তাদের পরিবার প্রকৃতই বিচার পেয়েছে কিনা, তা জানা বা তার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। যে সকল নারীর সম্মান ভূ-লুন্ঠিত হয়েছিল, তাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। যেসব অসহায় মানুষের সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল, তাদের সকলকে সহায়তা প্ৰদান করা সম্ভব হয়েছে কিনা, তাও বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যেটা সম্ভব, সেটি হল শপথ নেওয়া। একজন ভারতবাসী হিসাবে শপথ নেওয়া, একজন গণতান্ত্রিক দেশের বাসিন্দা হিসাবে শপথ নেওয়া, এই জনবিরোধী, শৃঙ্খলাহীন, অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রকে  সমূল উৎপাটন করতেই হবে। চির অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা যুগের দিকে পুরোপুরি চলে যাওয়ার আগে একবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে আমাদের এই সুবর্ণময়ী পশ্চিমবঙ্গকে বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করার। জনকল্যাণকামী, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে সমর্থ্য, জাতীয়তাবাদী ভাবধারা সম্পন্ন কোনো শাসনতন্ত্রের হাতেই পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে বলে অভিমত। বোমা, গুলির শব্দ আর ভারী বুটের আওয়াজের প্রতিধ্বনি বাংলার পরিচয় হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল, আছে এবং থাকবে। অপসংসস্কৃতির বাহকদের ছেড়ে চলে যেতেই হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। হয়তো সেইদিন আর বেশি দূরে নয়!

পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজকে পুনর্জাগরণ একান্ত প্রয়োজন।

Comments

Popular posts from this blog

মুর্শিদাবাদ কি মুঘলস্থানের পথে? ওয়াকফের নামে কীভবে হিন্দু নির্যাতন হয়েছে? ---- ডক্টর সুমন চন্দ্র দাস

"বন্দেমাতরম" প্রকাশের ১৫০ তম বর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি : ---- বিমল দাস

রাজা তোর কাপড় কোথায়? --- সুমন চন্দ্র দাস