স্মৃতির পাতা থেকে ---- সুমন কর্মকার
কলিং বেলটা বেজে উঠল। মোবাইলে দেখলাম 5.30 বাজে।ধরফরিয়ে উঠলাম। এত সকালে সাধারণত কেউ আসেনা। দরজা খুলে দেখলাম বাড়ির সামনে সারি দিয়ে তিনটা অটো দাঁড়িয়ে আছে। ব্যালকনি থেকেই মুখগুলো দেখা যাচ্ছিল -- রক্তশুন্য, বর্ণহীন, ভয়ার্ত। তারিখটা ছিল 3মে, 2021 -- বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়ে 24 ঘন্টাও পার হয় নি। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ -- দাঁত-নখ বের করে শাসকের পোষা হায়না গুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর।
পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক জেলা কোচবিহারের আসাম-বাংলা সীমান্তবর্তী তুফানগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা শুরু করে শাসক বাহিনী। অধিকাংশ মানুষ আসামের বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় নিতে শুরু করে 2 তারিখ রাতেই -- ভিটে মাটি ছেড়ে প্রান বাঁচানোর তাগিদে। যারা পালাতে পারে নি তারা অসহায় ভাবে ছুটে এসেছে একটু আশ্রয়ের আশায়, একটু আইনি সহযোগিতার জন্য।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভাবছিলাম একবিংশ শতাব্দীতে এসে মধ্যযুগীয় বর্বরতা প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাগ্য একমাত্র এই বাংলাতেই সম্ভব। নির্বাচন পরবর্তী হিংসার দুটো বছর পার হয়ে গেল। পেছন দিকে তাকিয়ে যখন দেখি তখন একটা বিষয় উপলব্ধি করতে পারি। এই নৃশংস অত্যাচার বা হিংসা আকস্মিক নয়। এটা ছিল একটা সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক সন্ত্রাস যাতে করে আগামী দিনে বিরোধী রাজনৈতিক সত্তার কোন অস্তিত্বই না থাকে। গনতান্ত্রিক পরিসরটা কে যতটা পারা যায় এই সুযোগেই সংকুচিত করে ফেলা।
বিগত দুটো বছরের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের দিকে তাকালে শাসক দলের এই পরিকল্পনার স্পষ্ট রুপ ফুটে ওঠে। খুন করে ঝুলিয়ে দেওয়াই হোক, গ্রাম ছাড়া করাই হোক, সরকারী সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাই হোক -- একের পর ঘটনা প্রমাণ করেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর ভাগারের শকুন সমগোত্রীয় হয়ে উঠেছে। নির্বিচারে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী খুন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মাতৃহারা শিশু, স্বামীহারা স্ত্রী, সন্তানহারা মা -- এদের আর্তনাদে সংবেদনশীল মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ হলেও শাসক যেন রক্তপানের এক অদ্ভুত খেলায় মেতেছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন মন্তব্য এই খুনিদের শুধু প্রশয়ই দেয় নি, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। জেহাদিরা অবাধে লুঠছে বাংলার মেয়েদের সন্মান এবং প্রান।
তবে ইতিহাস সাক্ষী আছে -- যে কোন স্বৈরাচারী যতটা অত্যাচার করতে পেরেছে, তার থেকেও ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে। এই ভয়াবহ রাজনৈতিক হিংসা আরও ভয়ংকর ঘটনার জন্ম দিবে আগামী দিনে। মানুষ এখনও ইশ্বর হয়ে যায় নি। তাই নিরাপরাধ, অতিসাধারণ, অত্যাচারিত মানুষ গুলো শুধু সঠিক সময়ের জন্য দিন গুনছে। আমার ধারণা যে দিন, যে মুহূর্তে সুযোগ পাবে, সেদিন আরও ভয়ংকর ইতিহাস রচনা হবে। জানিনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলেরা হিংসার এই চক্রাকার আবর্ত থেকে রাজ্যকে বের করতে পারবে কিনা। আগামী দিন গুলো এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
ভোর বেলায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা মানুষ গুলোকে ঘরে বসালাম। শুনলাম তাদের অভিজ্ঞতা। কী করনীর তা নিয়ে কিছু যোজনা করলাম। আগামী কদিন অত্যাচারিতদের এই স্রোত আমার বাড়িতে লেগেই রইল। আমিও মানুষ গুলোর হাত ধরে মানুষ হিসেবে জন্ম নেবার ঋণ শোধ করার খানিকটা চেষ্টা করলাম। তবে ঋণ শোধের প্রক্রিয়া এখনও সমান তালে চলছে। দেখা যাক আর কতদিন!
3য় মে, 2023
দুপুর 12.50
বাগডোগরা থেকে ব্যাঙ্গালোর যাবার আকাশ পথে।
Comments
Post a Comment