সবুজ সন্ত্রাসের দুই বছর ও তদন্তে আদালতের ভূমিকা: সম্পাদকীয়
রাজনৈতিক হিংসার পরম্পরা পশ্চিমবঙ্গের নামের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রাক-স্বাধীনতা পর্ব থেকে শুরু করে মুসলিম লীগের দাঙ্গা, নক্সাল আমলের অরাজকতা, কংগ্রেসী অত্যাচার, যুক্তফ্রন্টের গণসংহার হয়ে এসে বর্তমান শাসকের সময়ে রাজনৈতিক হিংসার ধর্মীয় সন্ত্রাসে ভোলবদল। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংগঠিত হিংসারতুল্যমূল্য বিচার করলে বোধহয় দাঁড়িপাল্লা যেদিকে ভারি হবে, তার নাম সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাস।
এ সন্ত্রাসে হাত কাটা গেছে পছন্দের দলকে ভোট দেবার ভুলে, এ সন্ত্রাসে গাছে ঝুলে প্রাণ দিতে হয়েছে দেশপ্রেম দেখানোর দোষে। শাসকদলকে ভোট দেওয়ার পরেও সর্বস্ব খোয়াতে হয়েছে কেবল হিন্দু হওয়ার অপরাধে। সেদিক থেকে ২০২১ সালের হিংসা সত্যিই এক অন্যমাত্রা নির্দেশ করে।
স্বতঃপ্রণোদিত মামলার প্রথম রায়ে গোটা মে মাসজুড়ে রাজ্যে ঘটে চলা সন্ত্রাসের উপর রিপোর্ট চেয়ে মুখ্যসচিব ও পুলিশের ডিজিপিকে তলব করে এবং হিংসা ঠেকাতে রাজ্য কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি, একথা জানিয়ে দেয় আদালত। সুপ্রিম কোর্ট মামলার শুনানিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব ও রাজ্য মুখ্যসচিবের কাছে রিপোর্ট চায়।
এরপর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের রিপোর্টে উঠে আসে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অস্তিত্বহীনতার কথা। বাংলায় 'আইনের শাসন নয়, চলছে শাসকের আইন' এমনই বলা হয় NHRC তদন্তের রিপোর্টে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিংসা ঠেকানো এবং সন্ত্রাসের তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করাতে সদর্থক ভূমিকা পালন করেন। সারা ভারতবর্ষ থেকে প্রবুদ্ধ সমাজের মানুষ দেশের রাষ্ট্রপতিকে পশ্চিমবঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করে চিঠি লেখেন। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার আবেদন নিয়ে জনস্বার্থ মামলার শুনানিও মঞ্জুর করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
নির্বাচনের পরিণাম প্রকাশের পরেই বিজেপি কর্মীসমর্থকদের উপর বেলাগাম হিংসার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্ট মিলিয়ে শতাধিক জনস্বার্থে মামলা দায়ের করা হয় তিনমাসের ব্যবধানে। সর্বমোট ৩৩৫০ এর অধিক হিংসার অভিযোগের হিসাব পাওয়া যায়, যার মধ্যে মাত্র ৬১৫ টি FIR নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ নিতে অস্বীকার এবং অভিযোগকারীকেই হেনস্থা ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগও নেহাত কম নয়।
এ নিয়ে বারংবার উচ্চ আদালতের তিরস্কারের মুখে পড়ে রাজ্য সরকার ও প্রশাসন।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে আরো একবার ধাক্কা খায় রাজ্য সরকার। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং শিশু ও মহিলাদের উপর অত্যাচারের মত অভিযোগের তদন্তভার CBI এর হাতে তুলে দেন বিচারপতিরা। পাশাপাশি, সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের SIT গঠন করে ৬ সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন তদন্তের রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মোট ৪টি CBI টিম গঠন করা হয় ১০৯ জন আধিকারিক নিয়ে, যারা বাংলার প্রতিটি জেলায় ভোট পরবর্তী হিংসার শিকার বিজেপি কর্মীসমর্থকদের এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে চার্জশিট জমা দিয়েছে। কার্যক্ষেত্রে তাদেরও বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। কোচবিহারে সিবিআই তদন্তকারীদের গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়া কিংবা মেদিনীপুরে তাদের গাড়ি ঘিরে তৃনমলী গুন্ডাদের বিক্ষোভ এসবেরই অংশবিশেষ।
ভোটের ফলপ্রকাশের পর থেকেই আনুমানিক ৫০ হাজার মানুষের বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়, ঘর ছাড়ার সংখ্যাও ৩০০০ হাজারের বেশি। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ভোট পরবর্তী হিংসার মামলায় নতুন মোড় আসে। ভোটের পরে সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে যাদের চলে যেতে হয়, তাদের বাড়ি ফেরানো ও ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেন বিচারপতিদের বেঞ্চ। গোটা পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি কমিটিও গঠন করা হয়, যারা ভোট পরবর্তী হিংসার প্রথম বর্ষপূর্তি থেকেই ঘরছাড়াদের ফেরানোর কাজ শুরু করে।
একুশ সালের অনিয়ন্ত্রিত ও পূর্বপরিকল্পিত সন্ত্রাস দমনে একদিকে যেমন রাজ্য সরকার ও প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ, অন্যদিকে অপরাধের মামলায় দ্রুত তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করা ও দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। আজ নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাসের দুই বছর পরেও, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষকে ন্যায়ালয় ও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে বিচারের আশায় যেতে হয়। আমরা শুধুই আশা রাখতে পারি, বাংলার মাটি থেকে গনতন্ত্রের নির্বাসন শীঘ্রই উঠে যাবে।

Comments
Post a Comment