ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ --- সুমন চন্দ্র দাস
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (৬ জুলাই ১৯০১ - ২৩ জুন ১৯৫৩) ছিলেন একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ, ব্যারিস্টার এবং শিক্ষাবিদ। যিনি জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভায় ভারতের প্রথম শিল্প ও সরবরাহ হিসাবে কাজ করেন। তিনি মন্ত্রী হিসাবে বেশ সফল ব্যাক্তি ছিলেন। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালের উপর বিশেষ ভাবনা চিন্তার ছাপ রেখে জান। হিন্দু স্বার্থ বিরোধী ভারত পাকিস্তানের মধ্যে "নেহরু-লিয়াকত" চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেন এবং এরপর তিনি নেহেরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে। জাতীয় কংগ্রেসের দিশা হিন্দু স্বার্থ বিরোধী হওয়ায় ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ভারতীয় জনসংঘ দলের প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। এই দলের বর্তমান উত্তরসূরি হল আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের আদিনিবাস ছিল হুগলীজেলার জিরাট-বলাগড় গ্রামে৷ পিতামহ গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৮৩৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জিরাট-বলাগড় গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন৷ তিনি ছিলেন মেধাবী৷ তিনি জিরাটের বিত্তশালীদের সাহায্যে কলকাতায় ডাক্তারী পড়তে আসেন এবং পরে জিরাট-বলাগড় গ্রাম ছেড়ে কলকাতার ভবানীপুরে বসতি স্থাপন করেন৷
দেশ ভাগের বিরোধী ছিলেন
ড.মুখার্জি ভারত বিভাজনের তীব্র বিরোধী ছিলেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে তিনি বলেন, ‘মুসলিমরা যদি ভারত বর্ষের বিভাজন চায় তবে ভারতের সকল মুসলিমদের উচিত তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাকিস্তান চলে যাওয়া।’ পরবর্তীকালীন সময়ে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এর বাড়িতে ভারত বিভাজন ও বাংলা বিভাজন নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও হিন্দু জেলা প্রতিনিধিদের নিয়ে দুটি আলাদা সভা হবে এবং সবার মতামত নেয়া হবে। একটি সভার ফলাফলও যদি বাংলা ভাগ এর পক্ষে যায়, তবে বাংলা ভাগ হবে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এর সভায় বাংলা বিভাজনের বিপক্ষে বেশি ভোট পড়ে। কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের সভায় বাংলা বিভাজনের পক্ষে ভোট পড়ে। ড.মুখার্জী এখানে বড়সড় ভূমিকা পালন করেন।
শিল্প মন্ত্রী হিসাবে সফলতা
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট নেহেরুর মন্ত্রিসভায় শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জী শিল্পমন্ত্রী রূপে শপথ গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর হিন্দু মহাসভাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে আত্মনিয়োগের পরামর্শ দেন তিনি। ভারতের শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শিল্প উন্নয়ন নিগম, প্রথম শিল্পনীতি প্রণয়ন, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ স্থাপন, সিন্ধ্রি সার কারখানা-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। খড়গপুরে ভারতের প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি স্থাপনা, কলকাতার প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্থাপনার ভাবনা তারই মস্তিষ্ক প্রসূত।
নেহেরু লিয়াকত চুক্তির বিরোধিতা
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বেড়ে চলে। হত্যা, লুন্ঠন, নারীর সম্ভ্রমহানি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রতিবাদে ১৪ এপ্রিল, ১৯৫০ নেহেরু মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হয়েও সংখ্যালঘু নিরাপত্তা (পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা) ও নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে লোকসভায় প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন ডঃ মুখার্জী। অবশেষে নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সঙ্গে সম্পর্ক এবং জনসংঘ স্থাপনা
১৯৫০ সালে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যু হয়। কংগ্রেসের মধ্যে জাতীয়তাবাদী শক্তির ভর কেন্দ্রে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে অনেক ভাবনা চিন্তার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গুরুজী গোলওয়ালকারের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে নতুন রাজনৈতিক দল, ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৫২ সালের মে মাসে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ভারতীয় জনসংঘ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনটি আসন লাভ করে। এরপর আইনসভায় ডঃ মুখার্জী লোকসভায় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব দান করেন। লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নিজেকে উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
কাশ্মীর এবং ধারা ৩৭০
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা চালু রাখলে অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা বাড়তে পারে তা তিনি বারবার লোকসভার ভিতরে ও বাইরে ব্যক্ত করেন। কাশ্মীর নিয়ে তিনি কোন রকম দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন না। স্পষ্ট বক্তব্য রাখতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সংবিধানের ৩৭০ ধারায় লেখা হয়। ‘Temporary, Transitional and Special Provision of Article 370’। সংবিধান প্রণেতা সাময়িক, পরিবর্তনমুখী ও বিশেষ কথাগুলির মধ্যে দিয়ে দূরদৃষ্টি প্রতিভাত হয়। তিনি স্পষ্ট বলেন একদেশে দুই নিশান, দুই বিধান চলবে না। এক দেশ এক আইন এবং এক নিশান থাকে। তিনি বেঁচে থাকলে আজকের কাশ্মিরের ছবিটা অন্যরকম হতো।
ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সংবিধানের বিশেষ অনুচ্ছেদ ৩৭০ ধারা বিলোপ ও পারমিটরাজ বাতিলের দাবিতে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কাশ্মীর অভিযান করেন। ১৯৫৩ সালের ১১ই মে পাঞ্জাবের উধমপুরে শেষ সভা করে কাশ্মীরে প্রবেশের পথে গ্রেফতারি বরণ করেন।
নেহেরুর চক্রান্ত
জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ নং ধারা নিয়ে নেহরু মন্ত্রিসভার(কংগ্রেস) সাথে মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৩ সালের ১১ই মে[৯] শ্যামাপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করে জম্বু কাশ্মীর পুলিশ। তাঁকে জেলবন্দি করা হলে তিনি বন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৫৩-র ২৩ জুন রহস্যময় ভাবে কাশ্মীরে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুর তদন্ত আজও হল না। দেশের কংগ্রেস বিরোধী এবং রাষ্ট্রবাদীরা মনে করেন ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে কংগ্রেস সরকার চক্রান্ত করে হত্যা করেছে।
পরিশেষে বলে রাখা বলে রাখা ভালো বাঙ্গালীর শেষতম সফল রাজনীতিজ্ঞ ব্যাক্তি হিসাবে শ্যামাপ্রসাদের উত্তরসুরীরা সারা ভারতবর্ষে গত নয় বছর ধরে রাজত্ব করছেন। পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীনতার পচাত্তর বছর কেটে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ নির্মিত হয়নি। আমাদের উত্তর প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে সেই দায়িত্ব বর্তায়। বামপন্থীরা যাকে ভুলিয়ে দিয়েছেন আজ আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে সেই ইতিহাসকে তুলে ধরতে হবে।

Comments
Post a Comment