হত্যাকান্ডের পাঁচ বছর পরেও বিচারের পথ চেয়ে রাজেশ-তাপসের পরিবার : দেবাঞ্জন পাল
২০১৮ থেকে ২০২৩। দলঞ্চা নদী দিয়ে পাঁচ বছরে অনেকটাই জল বয়ে গেছে। দাড়িভিটে কার নির্দেশে গুলি চলল, তা এখনো জানা সম্ভব হয় নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী গুলি চালায় উর্দিধারী পুলিশ। আর পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ মানেই শাসকের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে একের পর এক নির্লজ্জ সংগঠিত অপরাধ।
ইসলামপুরের দাড়িভিট বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষকের দাবি নিয়ে চলা আন্দোলনে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের গুলিতে দুই ছাত্রের মৃত্যু ঘটে পাঁচ বছর আগে। বিডিও অফিস থেকে লিখিত আশ্বাস সত্ত্বেও স্কুল পরিচালনা সমিতির সভাপতি তৃণমূল নেতা নিশাচন্দ্র গনেশ, তৃণমূল কংগ্রেসের অঞ্চল সভাপতি সুবোধ মজুমদার, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নুরুল হুদা, প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডুদের মিলিত ষড়যন্ত্রে উর্দু শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এই চক্রান্তে বিশেষ নেতৃত্ব দেয় ভিলেজ পুলিশ মহম্মদ রেজা। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর উর্দু ভাষাশিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে তুমুল উত্তেজনা ছড়ায় দাড়িভিট স্কুলে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে স্থানীয় তৃণমূল নেতা কার্তিক বৈরাগী বহিরাগতদের মদতে অতর্কিত ভাবে স্কুল প্রাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলা করে। ইতিমধ্যেই পুলিশ স্কুলে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের অকথ্য গালিগালাজ, ধরপাকড় ও কাঁদানে গ্যাসের হামলা করতে শুরু করে। সেই সঙ্গে চলে লাঠিচার্জ। পরিশেষে বিনা প্ররোচনায় গুলিচালনা। ছাত্র বিক্ষোভ দমনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ABVP দাড়িভিট শাখার সহ সম্পাদক রাজেশ সরকার এবং তাপস বর্মণের।
সিআইডি তদন্তের নামে বছরের পর বছর কাটিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা বরাবরের মতোই ন্যক্কারজনক। দোষীদের প্রশাসনিক সহায়তায় আড়াল করা হয়েছে। অবশেষে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা যায় এই বছরের এপ্রিল মাসে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে। দাড়িভিট কান্ডে সিআইডি তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা। দাড়িভিটের স্কুলে গুলিচালনায় পুলিশের ভূমিকা ও পরবর্তীতে আনুষঙ্গিক তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে এজলাসে প্রশ্ন তোলেন মহামান্য বিচারপতি।
তদন্তের বিষয়ে মহামান্য বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, "যেখানে ময়নাতদন্তর রিপোর্টে স্পষ্ট, কোনও শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে, সেখানে এতদিনেও সিআইডি কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে সেটা শনাক্ত করতে পারল না? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ও সিআইডি তদন্তের কোনও মিল নেই।" স্পষ্টতই, পরস্পর বিরোধী রিপোর্ট দেখে হতভম্ব হাইকোর্ট।
"পুলিশ গুলি না চালালে, গুলি চালাল কে?" একই প্রশ্ন তুলেছিল বিপ্লব সরকার, দাড়িভিট ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী, সেদিন পুলিশের বেপরোয়া গুলি যার পায়ে গিয়ে বিদ্ধ হয়। "যদি পায়ের বদলে বুকে গুলি লাগত?" স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজও শিউরে ওঠে সেদিনের স্কুলপড়ুয়া বিপ্লব।
ঘটনায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন মৃতের পরিবার। সেই মামলার শুনানিতেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সংশয় এবং সিআইডি তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মহামান্য আদালত। ঘটনার পাঁচ দিন পরে কেন সিআইডি তদন্ত শুরু করল আর কেনই বা দীর্ঘ চার বছরেও সিআইডি তদন্ত শেষ করতে পারলনা, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। আদালতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জমা দেওয়া তদন্তের রিপোর্টেও অভিযোগ, তদন্তের স্বার্থে রাজ্য প্রশাসনের কোনও সহযোগিতা তারা পাননি।
কলকাতা হাইকোর্টের এন.আই.এ তদন্তের নির্দেশে নৈতিক জয় অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের। গত পাঁচ বছর ধরে ইসলামপুর তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দাড়িভিট ঘটনায় দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে পাশাপাশি ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যজুড়ে মাতৃভাষা দিবস পালন করতে ভূমিকা নেয় এবিভিপি। তাই এবিভিপির আপোষহীন লড়াই হাইকোর্টের নির্দেশে আলোর মুখ দেখল।
পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও দুটি পরিবার আজও বিচারের পথ চেয়ে বসে। সেই বিচার কবে মিলবে, তা সময়ই বলবে। তবে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গকে মৌলবাদী উর্দু আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেব না আমরা- এটুকু পণ নিজেরা করতেই পারি।
"২০শে সেপ্টেম্বর- উর্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বুক পেতে গুলি খাওয়ার দিন।
বাঙ্গালীর হিন্দু হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে মাতৃভাষাকে বাঁচানোর দিন।"

Comments
Post a Comment