বাংলাদেশে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণেই মৌলবাদীরা আক্রমণ করছে --- ড. সুমন চন্দ্র দাস

 



গত ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, “দেশের সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ সাম্প্রদায়িক নয়, সবটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।” হাসিনাকে দেশ থেকে বিতারিত করে অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ারে মহম্মদ ইউনূস বসে পুলিশে তদন্তের নির্দেশ দিলে সরকার পক্ষের দাবিটা ঠিক এমনই। আর তাকে ঘিরেই বিশ্বে এখন নিন্দার ঝড়।

তাহলে প্রশ্ন হল, হিন্দুধর্মগুরু চিন্ময়প্রভুকে মিথ্যা মামলা থেকে হিন্দু মন্দির ভাঙচুর, হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ, খুন, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি সবটাই রাজনৈতিক চক্রান্ত? কেন দুর্গাপুজোর সময় এবং বিসর্জনের সময় বাদ্যযন্ত্র বন্ধ রাখার ফাতোয়া জারি করেছিল প্রশাসন? কেন উত্তরায় দুর্গাপুজা করলে খুনের স্লোগান দেওয়া হয়েছিল? কেন ইসকন মন্দিরের জগন্নাথদেবের মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় হিন্দুদের পিষে মারার নিদান দেওয়া হয়েছিল? এই সব প্রশ্নের ভিত্তি কি সাম্প্রদায়িক, নাকি কেবল রাজনৈতিক? অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তার সঠিক বিশ্লেষণ দেওয়া হয়নি। ফলে শাক দিয়ে মাছ যে ঢাকা যায় না, তা ইউনূস প্রশাসন আরও একবার প্রমাণ করল।

বাংলাদেশ নিউজ আউটলেট ঢাকা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, “পুলিশ তদন্তে জানিয়েছে দেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মোট হামলা ও ভাঙচুরের রিপোর্ট করা ১৪১৫টি ঘটনার মধ্যে ৯৮.৪ শতাংশ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত। শুধুমাত্র ১.৫৯ শতাংশ ঘটনা সাম্প্রদায়িক কারণে ঘটেছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রচার বিভাগের মুখপাত্র সূত্রে পুলিশের অনুসন্ধানের এই তথ্য প্রকাশ করেছে। ১৭৬৯টি হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১৪১৫ টি ঘটনার তদন্ত শেষ হয়েছে। ৩৫৪টি মামলার তদন্ত এখনও চলছে। তদন্ত করা মামলাগুলির মধ্যে ১২৫৪ টি প্রমাণিত হয়েছে এবং ১৬১টি ক্ষেত্রে প্রমাণের অভাব রয়েছে।  মোট মামলার মধ্যে ১৪৫২টি ঘটনা ঘটেছিল এক দিনেই।” 

আসুন তাহলে দেখে নিই কীভাবে হামলার পরম্পরা চলেছে ওই দেশে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার মোট ২০১০টি ঘটনা ঘটেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঘটনার সংখ্যা আরও অনেক বেশি। হাসিনাকে বিতারিত করার পর ৩ দিনের মধ্যে হিন্দু মন্দির, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৬০ জনের বেশি হিন্দু শিক্ষক, অধ্যাপককে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী এবং ব্লগার আসাদ নূর বলছেন, “হিন্দুদের জামাতে-ইসলামী-তে যোগদান করতে বাধ্য করা হচ্ছে।” আবার বিশিষ্ট লেখিকা একাধিক বার হিন্দু নির্যাতন নিয়ে বিস্ফোরক হয়েছেন। বিএনপি এবং জামাত বাংলাদেশকে হিন্দু শূন্য করতে চাইছে। ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে গণেশ ঠাকুরের শোভাযাত্রায় হিন্দু ভক্তদের উপর হামলা করা হয়েছিল। দুর্গাপুজার সময় ময়মনসিংহে ইয়াসিন মিয়া নামক এক ব্যক্তি গৌরীপুর শহরের পুজোতে হামলা চালায়। ঋষিপাড়া বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে, মানিকাদি পালপাড়া বারোয়ারিতে ২৮ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর মুলসমানরা হামলা করেছিল। দুর্গার পুজোর অষ্টমীতে ঢাকার তাঁতি বাজার এলাকায় পেট্রোল বোমা মারা হয় পুজো মন্দিরে পুস্পঞ্জলি দেওয়ার সময়।

৩রা অক্টোবর, বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জে গোপীনাথ জিউর আখড়া দুর্গা পূজা মণ্ডপে হিন্দু দেবদেবীর ৭টি মূর্তি  ভাঙা হয়। ৫ নভেম্বর, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরের হাজারী গলিতে হিন্দু সম্প্রদাযয়ের ওপর পুলিশ ব্যাপক মারধর করে। ২৯ নভেম্বর, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার পাথরঘাটায় একটি হিংস্র মুসলিম জনতা হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করে ৩টি মন্দির ভেঙে দেয়। মুসলমানরা যে হিন্দু ধর্মীয় স্থানগুলোকে টার্গেট করেছিল তার মধ্যে রয়েছে শান্তনেশ্বরী মাতৃ মন্দির, শনি মন্দির এবং কালীবাড়ি মন্দির। শুক্রবার নামাজের পরপরই এই হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ৩০ নভেম্বর  বাংলাদেশের ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে মুন্নি সাহা নামে একজন বিশিষ্ট হিন্দু সাংবাদিককে পুলিশ মিথ্যা মামলায় আটক করেছিল। ১৩ ডিসেম্বর একদল জেহাদিরা মহাশ্মশান কালী মাতা মন্দিরে আক্রমণ করেছিল। সেখানে ৭টি দেবতার মূর্তি ভাংচুর করে এবং সোনার অলঙ্কার চুরি করেছিল।

১৯ ডিসেম্বর, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলায় আলাল উদ্দিন নামে একজন মুসলিম ব্যক্তি পলাশকান্দা কালী মন্দিরে একটি মূর্তি ভাংচুর করেছিল। এখানকার আজহারুল নামে এক ৩৭ বছর বয়সী মুসলিম ব্যক্তি  বেশ কয়েকটি দেবদেবীর মূর্তি ভাংচুর করেছিল। একই ভাবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু এবং তাঁর  সহযোগীদের সাম্প্রতিক সময়ে মিথ্যা মামলায়  গ্রেফতার করেছে ইউনূস প্রশাসন। সকল হিন্দু সংগঠন ইসকনকে নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা  এবং 'রাষ্ট্রদ্রোহ' মামলা দিয়ে হিন্দু বিক্ষোভ দমন করার কাজ তীব্র গ্রতিতে করছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই ভাবে আবার গুজব রটিয়ে এবং ইসলামকে অবমাননার অজুহাতে হিন্দুদের ওপর হামলার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। হৃদয় পাল,  উৎসব মন্ডল,  পার্থ বিশ্বাস পিন্টু, আকাশ দাস এবং  উত্সব কুমার গায়নের ওপর সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি নিপীড়নের উজ্জ্বল উদাহরণ। হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হিংসা, ভুয়ো মামলা দিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছে।

‘ব্রা’ হাতে নিয়ে উল্লাসে মেতেছিল জামাত!

গত ৫ অগাস্ট থেকে উত্তপ্ত বাংলাদেশ। ‘কোটা’ বনাম ‘মেধাবী’ আন্দোলনের অন্তরালে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের গণভবন লুট করেছে। একই ভাবে একজন ৭৫ বছরের মহিলার ব্রা হাতে নিয়ে উল্লাস করেছে ওই দেশের জামাত শিবির ও বিএনপির সমর্থকরা। বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙচুর এবং মাথায় মূত্র ত্যাগের ঘটনায় বিরাট নিন্দার ঝড় উঠেছিল। আন্দোলনের আড়ালে ছিল ক্ষমতার দখল। হাসিনাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে ক্ষমতায় বসেছেন মহম্মদ ইউনূস। এরপর থেকেই আওয়ামি লিগ এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর লাগাতার আক্রমণ হয়ে চলেছে। অপরদিকে পাকিস্তানের করাচী বন্দর থেকে লাগাতার চট্টগ্রাম বন্দরের মালামাল আসছে। বিশেষজ্ঞদের মত গোপনে অস্ত্র আমদানি করেছেন ইউনূস। দেশের অভ্যন্তরে ঢাকায় ভারতবিরোধী ভাবনার স্পষ্ট উচ্চারণ হয়েছে। সীমান্তে বিজিপি ভারতের বিএসএফের সঙ্গে আচরণ বদলে ফেলেছে। সীমান্তে অনুপ্রবেশ এবং ভারতের জমি দখলের চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। আর ঢাকা সহ একাধিক জেলায় মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট, ধর্ষণ, খুন, হত্যা ইত্যাদি ঘটে চলেছে। তবুই নির্লজ্জ ইউনূস নিজের কৃতকর্মের জন্য কোনও অনুতাপ করেননি।

Comments

Popular posts from this blog

মুর্শিদাবাদ কি মুঘলস্থানের পথে? ওয়াকফের নামে কীভবে হিন্দু নির্যাতন হয়েছে? ---- ডক্টর সুমন চন্দ্র দাস

"বন্দেমাতরম" প্রকাশের ১৫০ তম বর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি : ---- বিমল দাস

রাজা তোর কাপড় কোথায়? --- সুমন চন্দ্র দাস