রাজেশ - তাপসের জন্য ন্যায় বিচার চাই ---- ড. সুমন চন্দ্র দাস
২০ শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার অধিকার ও বাংলা শিক্ষক চেয়ে আন্দোলন করে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়ে হুতাত্মা প্রাপ্তি হয়েছেন দাড়িভীটের তপশিলি সমাজের দুই তরুণ রাজেশ সরকার এবং তাপস বর্মন । আজ দুবছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে কিন্তু কোন দুষ্কৃতী কার নির্দেশে গুলি চালিয়ে বাংলা মায়ের কোল খালি করেছে সেই সম্পর্কে এখনও দোষীদের চিহ্নিত করা সম্ভব পর হয় নি।যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য স্কুলে গুলি চালিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। আর পুলিশ এখন শাসকের জল্লাদ।
সিআইডি তদন্তের নামে পশ্চিমবঙ্গের সন্তান হারা মায়েদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা চলছে। এখনও পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসন কোন সদর্থক ভূমিকা পালন করে নি। উল্টে বাংলার শিক্ষক চেয়ে যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের কে আরবের দাস উর্দু প্রেমী তৃণমূলের দলদাস পুলিশ রীতিমত হেনস্থা করছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে শাসক দলের রাজনৈতিক নেতাদের দলদাসে পরিণত হয়েছে পুলিশ। ৩৪ বছরের হার্মাদদের মতন এখন উন্মাদ পার্টির ক্যাডার হলেন পুলিশ । রীতিমত তৃণমূল পার্টি কর্মীর ভূমিকা পালন করছেন পুলিশ প্রশাসন।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাংলা ভাষা আন্দোলনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐদিন সৈয়দ বরকত রফিরা উর্দুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আমাদের ঘরের ছেলে পশ্চিমবঙ্গের ছেলে দাড়িভীটের ছেলে রাজেশ - তাপস ২০১৮ সালের বাংলার শিক্ষক চেয়েছেন বলে প্রকাশ্য দিবালোকে স্কুল চত্বরে পুলিশের মদতে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হতে হল। অথচ এটা কোন ঘটনাই নয় বলে পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজ মেনে নিল এর থেকে লজ্জা পশ্চিমবঙ্গের জন্য কি হতে পারে। ঢাকার আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবো অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী সন্তানদের উর্দু নয় বাংলা পড়ার জন্য গুলি খেয়ে মরতে হবে এবং এই ঘটনার জন্য মাতৃভাষা প্রেমীরা মুখে কুলুপ দেবেন এর থেকে কলঙ্ক জনক অধ্যায় আর কি হতে পারে।
বাঙ্গালীর জাতি সত্তা আত্ম অভিমান সাংস্কৃতিক উৎকর্ষার দৃষ্টান্ত কি এই যে বাংলা শিক্ষক চেয়ে আন্দোলন করলে গুলি খেয়ে বাংলার দামাল ছেলেদের হত্যা হতে হবে? বাংলার ভাষা সংস্কৃতির বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কলমের কালি কি শেষ নাকি উর্দু কে বামপন্থী নকশাল বুদ্ধিজীবীরা মাতৃভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন? পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেক বাংলা ভাষা কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক নাট্যকারের কাছে একটাই প্রশ্ন কেন রাজেশ-তাপস কে বাংলার শিক্ষক চেয়ে গুলি খেতে হল কেন ? এই কি আমাদের বঙ্গভূমি তথা বাঙ্গালাদেশ তথা পশ্চিমবঙ্গ তথা বিশ্ব বাংলা। বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ কি এই বঙ্গদেশ চেয়ে ছিলেন? বাংলা ভাষার জন্য শিক্ষক চাওয়া টা কি খুব অন্যায় ছিল? পশ্চিমবঙ্গের সুশিক্ষিত বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক বাহক প্রত্যেক বাঙ্গালীর কাছে আমার একটাই প্রশ্ন কেন সেই দিন বাংলার শিক্ষক চেয়ে দুজন তরুণ বাংলার ছেলের বুকে গুলি করা হল?
২০ ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ দাড়িভীটের স্কুলে স্পোর্টসের দিন ছিল। বিডিও সাহেব লিখিত দিয়ে জানিয়েছিলেন যে উর্দু শিক্ষক স্কুলে নিয়োগ করা হবে না। কিন্তু স্কুল পরিচালনা সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি নিশা চন্দ্র গনেশ, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নুরুল হুদা, প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু একান্ত ভাবেই স্কুলে কোন উর্দু ছাত্র ছাত্রী না থাকা সত্ত্বেও উর্দু শিক্ষক নিয়োগে প্রধান তৎপর ছিলেন। স্থানীয় ভাবে এই চক্রান্তে বিশেষ ভাবে নেতৃত্ব দেয় ভিলেজ পুলিশ মহম্মদ রেজা। বাংলার জন্য রক্তপাত থেকে উক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি এবং পুলিশ প্রশাসন হত্যার দায় থেকে হাত মুক্ত করতে পারেন না। সবটাই পরিকল্পনা ও চক্রান্ত ছিল। কলকাতা থেকে আসানসোল, ইসলামপুর থেকে ইকবালপুর সর্বত্র বিভিন্ন পোস্টার ব্যানার নজরে রাখুন মিনি পাকিস্তানের জনকরা এখন বাংলা ভাষায় কোন লেখা লেখেন না তাদের কাছে উর্দু হল প্রধান মাধ্যম।
বাংলার শিক্ষক বাংলা ভাষা থেকে দাড়িভীটের মানুষদের বঞ্চিত করে উর্দু শিক্ষক নিয়োগে পরিকল্পনা ও চক্রান্ত করেন। এদিকে ঐ দিন বেলা বারার সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ছাত্র ছাত্রী অভিভাবক সকলেই স্কুলের মাঠে উর্দু শিক্ষক নিয়োগের তীব্র বিরোধিতা করে। প্রত্যক্ষদর্শী নরেন শিকারী জানান বেলা ২টোর সময় স্থানীয় গোলাপাড়া এলাকার তৃণমূল নেতা কার্তিক বৈরাগী বহিরাগতদের মদতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য অতর্কিত ভাবে স্কুল প্রাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলা করে। ইতি মধ্যেই পুলিশ স্কুলে ঢুকে ছাত্র ছাত্রীদের অকথ্য গালিগালাজ ও ধরপাকড় শুরু করে। এমনকি স্কুলের ক্যাম্পাসে বেপরোয়া পুলিশের গাড়ি ঘোরাতে থাকে। এই মুহূর্তে পুলিশ হঠাৎ কাঁদানে গ্যাসের হামলা করেতে শুরু করে। সেই সঙ্গে চলে লাঠিচার্জ। ইতি মধ্যেই স্কুলের রাস্তা অবরোধ হয়ে যায়। পুলিশ উত্তর থেকে দক্ষিণে ধেয়ে আসতে শুরু করে। হঠাৎ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে একটা গুলি স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র বিপ্লব সরকারের পায়ে লাগে। তারপর স্কুলের ছাত্রী বোন মৌ সরকারকে উদ্ধার করতে গিয়ে দাদা রাজেশ সরকারের বুকে গুলি লাগলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ইতি মধ্যেই স্কুলের সামনে মিষ্টির দোকানে আশ্রয় নেওয়া তাপস বর্মনের পেটে গুলি এসে লাগে। ঘড়ির কাটা তখন বেলা ৪.৩০ মি. । বহিরাগতদের তৃণমূলের দুষ্কৃতী এবং পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতে এই ভাবে গুলি বর্ষণ করে বাংলা ভাষা ও বাংলা শিক্ষক চেয়ে আন্দোলনকে দমন করে পুলিশ প্রশাসন। স্কুল প্রাঙ্গনে বাংলা ভাষার শিক্ষক চাওয়ার অপরাধে এই রক্তের খেলা হয় তো স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গ প্রথম দেখলো।
অথচ বামপন্থী নকশাল বাংলা প্রেমী কবি সাহিত্যিক ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক নাট্যকারদের চোখে কানে নাকে এই নির্মম হত্যার খবর পৌঁছায় না।
গুলিতে আহত ছাত্রীদের ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে রাস্তায় আহত ছাত্রদের গোলপাড়াতে মহম্মদ রেজা দুষ্কৃতীদের নিয়ে আরেকবার হামলা করে। গুলি লাগার স্থানে পাথর দিয়ে আঘাত করে। যারা নিয়ে যাচ্ছিলেন অনেকেই আহত হন দুষ্কৃতীদের দ্বারা। অবশেষ সন্ধ্যা ৬.৩০ মি নাগাদ ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে রাজেশ সরকারকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। তাপস বর্মন এবং বিপ্লব সরকারকে শিলিগুড়ি মেডিক্যাল হাস পাতালে পাঠানো হলে রাস্তায় তাপস বর্মনের মৃত্যু হয়। বিপ্লব সরকারের চিকিৎসা চলতে থাকে। বিপ্লবের জন্য অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ সমস্ত রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রথমে গুলি তারপর সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না দেওয়া সবটাই পরিকল্পনা ও চক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসন এই ঘটনার দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারে না। উল্টো ঐ দিন রাতে আরও নির্দোষ নয় জন সাধারণ গ্রামবাসীদের গ্রেফতার করে। অথচ দোষীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে গুলিতে মৃত রাজেশ সরকার এবং তাপস বর্মনের নিথর দেহ বলেংচা নদীর ধারে সমাধিস্থ করে রাখা হয়। বাংলা মায়ের কোল খালি করেছে মৌলবাদী তৃণমূল সরকার। এলাকার দুই বিধায়ক গোলাম রববানি এবং কানাইলাল আগারওয়ালকে এই হত্যাকান্ডের পেছনে সক্রিয় ইন্ধন আছে বলে মনে করা হয়। ঘটনায় যে শাসক প্রশাসকের ভূমিকা স্পষ্ট আছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
ইতি মধ্যেই মাননীয়া মূখ্যমন্ত্রী ইতালি সফর থেকে ঘোষণা করলেন সমস্ত ঘটনার পেছনে আর এস এস, বিজেপি রয়েছে। কোন তদন্ত না করেই মাননীয়া পুলিশ মন্ত্রী উপযুক্ত তদন্তের নির্দেশ না দিয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। ফলে পুলিশ মন্ত্রী, পুলিশ প্রশাসন এবং তৃণমূলের গুন্ডারা এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত ছিলেন বলেই সব ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত।
ইতি মধ্যেই গোটা ইসলামপুরে সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ সিবিআই তদন্তের জন্য পথে নামে। গত দুই বছর ধরে আন্দোলন করছে বিদ্যার্থী পরিষদ। আন্দোলনে যোগদান করছে সাধারণ মানুষ, ছাত্র -ছাত্রী নারী প্রমুখ।
টানা ৫৭ দিন পর স্কুল শর্ত সাপেক্ষে খোলা হয়। ৯জন সাধারণ গ্রামবাসীদের শর্ত সাপেক্ষে ছাড়া হয়। এসডিও সাহেব সিবিআই তদন্তের জন্য স্কুল মাঠে সর্বদলীয় বৈঠকে বিশেষ লিখিত দেন কিন্তু তারপর কোন অগ্রগতি হয়নি। পুলিশ প্রশাসন সিআইডি তদন্ত করলেও দুবছর হত্যাকারীদের এখনও চিহ্নিত করতে পারে নি। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ এবং গ্রামবাসীরা এই নির্মম হত্যার বিরুদ্ধে এখনও সিবিআই তদন্তে সরব। বিদ্যার্থী পরিষদ বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য প্রত্যেক পশ্চিমবঙ্গবাসীকে বীরগতি প্রাপ্ত রাজেশ তাপসের নাম ভুলতে দেবে না।
বাংলা ভাষা ও বাংলার শিক্ষক চাওয়ার অপরাধে পুলিশের উপস্থিতিতে তৃণমূলের গুন্ডারা যেভাবে গুলি চালিয়ে বাংলা মায়ের কোল খালি করল তার বিচার কবে হবে? কলকাতা থেকে ৫২৭ কিমি দূরে বাংলা ভাষার জন্য শিক্ষক চেয়ে হুতাত্মা কথা কি সুশিক্ষিত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কর্ণে পৌছাবে না? ঘরের ছেলে রাজেশ - তাপসের কোল হারা মায়েদের ক্রন্দন ধ্বনি কি বাংলা সাহিত্য একাডেমি কিংবা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পন্ডিতদের কর্ণ কুহুরে পৌছাবে না? নাকি বাঙালি সমাজ বর্ণ দেখে জাতি দেখে ভাষা রক্ষার প্রতিবাদ করে? নাকি পশ্চিমবঙ্গের সুশীল শিক্ষিত সমাজ আগামী দিনে মৌলবাদী উর্দু ভাষার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ভবিষ্যত বাঙ্গালী সমাজকে কোন পথে পরিচালিত করবে তার দায়িত্ব বর্তমান বাঙ্গালী সমাজের কাছেই। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কন্ঠ তুলুন আর বলুন -
রাজেশ - তাপসের জন্য ন্যায় বিচার চাই।
ড. সুমন চন্দ্র দাস

Comments
Post a Comment